সিরকা -বা- সির্কা

আরবি শব্দ (خل) খল বা সিরকা হল এক ধরনের তরল পানীয় ।

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ সির্কা (টক ও ঝাঁঝযুক্ত) পানীয় উত্তম তরকারী “ (ইবনে মাজাহ, হাদীছ শরীফ নং-১/৩৩১৬)

উসমান ইবন আবী শায়বা (রহঃ) জাবির ইবন আবদিল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “উত্তম তরকারি হলো সির্কা বা আচার” (সুনান আবূ দাউদ অধ্যায়ঃ ২১/ খাদ্যদ্রব্য (كتاب الأطعمة) হাদীছ শরীফ নং-১/৩৭৭৭) (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

উম্মু সা’দ (রাঃ) বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা (রাঃ) র নিকট আসলেন। আমি তখন তার কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বলেন “ সকালের নাস্তা আছে কি? ” তিনি বলেন, আমাদের নিকট রুটি, খেজুর ও সির্কা আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সির্কা উত্তম তরকারী। হে আল্লাহ! সির্কায় বরকত দান করুন, কারণ তা ছিল আমার পূর্বকালের নবীগণের তরকারী। যে ঘরে সির্কা আছে সে ঘরে কখনও তরকারীর অভাব হয় না”। (ইবনে মাজাহ শরীফ: হাদীছ শরীফ নং-৩৩১৮)

মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন তখন উনার সঙ্গে করে সিরকা নিয়ে আসেন ।

সিরকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড (CH3COOH) ও পানির মিশ্রণে তৈরি। বিভিন্ন ফলের রস চিনি বা ইথানলকে গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যাসিটিক অ্যাসিডের তরলে পরিণত করা হয়। উক্ত তরলে ইথানল দ্রবীভূত হয়ে সিরকায় রূপান্তরিত হয়। কিংবা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করেও এটি প্রস্তুত করা হয়। রান্না, চিকিৎসা, রূপচর্চা, বিভিন্ন গৃহস্থালি প্রয়োজনে কিংবা কোনো কিছু পরিষ্কার বা জীবানু মুক্ত করা ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে সিরকার স্বার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। সিরকার অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে । ১ টেবিল চামচ সিরকায় আছে -

০.৯ গ্রাম শর্করা

০.৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম

০.১ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানান রান্নায় সিরকা ব্যবহৃত হয়। আচার কিংবা সালাদ বানানো ইত্যাদি অনেক কিছুতেই সিরকা ব্যবহার করা হয় অহরহ। আমাদের দেশে সাধারণত রান্নায় সাদা সিরকা বেশি ব্যবহার করা হয় । রান্নার সিরকায় এসিডের পরিমান বেশি থাকে তাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে রান্নার সিরকা ব্যবহার করলে উপকারের থেকে ক্ষতির সম্বাবনা বেশি থাকে ।

সিরকার উপকারিতা

গ্যাস্টিকের সমস্যা সম্পূর্ণ রুপে দূর করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
ব্লার্ড প্রেশার বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ।
কোলেস্টেরল কমায়,ও হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে ।
এলার্জি ও বিভিন্ন চর্ম রোগে কার্যকরী।
ক্ষুধা কম লাগা বা রুচি বারাতে কার্যকরী।
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
পেটের চর্বি ও ওজন কমাতে সিরকা কার্যকরী।
হজমে সহায়তা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া সহ অন্ত্রের অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দেয়।
ব্রোন ও রোদে পোড়া ভাব দূর করে।ঘামের দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া প্রতিহত করে ।

সিরকার উপকারিতা ও ব্যবহার

গ্যাস্টিকের সমস্যায় : যাদের গ্যাস্টিকের সমস্যায় রয়েছে, তারা প্রতিদিন খাবার পর ১/২ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা মিশিয়ে দিনে ৩ বার খেলে ইনশাআল্লাহ গ্যাস্টিকের সমস্যা সম্পূর্ণ রুপে দূর হবে ।
ক্ষুধা কম লাগা বা রুচী বৃদ্ধী : যাদের এই সমস্যা রয়েছে,তারা প্রতিদিন খাবার পর ১/২ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা মিশিয়ে দিনে ৩ বার খেলে ইনশাআল্লাহ রুচী বৃদ্ধী ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান হবে ।
ওজন ও চর্বি কমাতে : নিয়মিত সিরকা খাওয়ার অভ্যাস করলে ওজন কমানোর প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হয়। যাদের ওজন ও পেটের চর্বি সমস্যায় রয়েছে তারা প্রতিদিন খালি পেটে ১/২ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা মিশিয়ে কিংবা লাল চা এর সাথে সিরকা মিশিয়ে নিয়মিত খেলে ইনশাআল্লাহ অতিরিক্ত ওজন ও পেটের চর্বি কমাতে সাহায্য করবে।
উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখতে : সিরকা রক্তের চর্বি ও কোলেস্টেরল কমায় । রক্ত চলাচলের শিরায় জমে থাকা চর্বি দূর করে রক্ত চলাচল মশ্রিন করে । তাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও হৃৎপিণ্ডের উপর চাপ কমায় তাই হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার রয়েছে তারা প্রতিদিন খাবার পর ১/২ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা মিশিয়ে দিনে ৩ বার খেলে ইনশাআল্লাহ সমাধান পাওয়া যাবে ।
ডায়াবেটিসের জন্য : কয়েকটি গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে শর্করা জাতীয় খাবারের সাথে সিরকা খেলে রক্তে শর্করার প্রবেশ কিছুটা ধীর হয়। সিরকা পাকস্থলী থেকে খাদ্য শোষণকে ধীর করে দেয়, ফলে খাবারের শর্করাটা ধীরে ধীরে রক্তে মেশে। ।এভাবেই শর্করা আরও ভালো করে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সিরকা পরিপাকের কিছু এনজাইমকে রোধ করে যেসব এনজাইমের কাজ হলো শ্বেতসারকে শর্করার ক্ষুদ্র কণা রূপান্তরিত করা । ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা ১/২ কাপ পানির সঙ্গে মিশিয়ে রাতে ঘুমানোর আগে খেলে সকালে রক্তে শর্করা প্রায় ৪-৬ শতাংশ কমে । তাই যাদের ডায়াবেটিস সমস্যায় রয়েছে তারা নিয়মিত সিরকা খাওয়ার অভ্যাস করলে ইনশাআল্লাহ উপকার পাওয়া যাবে ।
হজমে সহায়তা করে : অনেকেরই হজমে সমস্যা আছে। কিছু খেলেই হজমের সমস্যা হয় যাদের তাদের জন্য সিরকা বেশ উপকারী। সিরকা হজমে সহায়তা করে। যাদের এই সমস্যায় রয়েছে তারা প্রতিদিন খাবার পর ১/২ গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা খেলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে । এছাড়াও সিরকা খাবার থেকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে সহায়তা করে।
ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে কার্যকরী : কিছু গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত সিরকা খেলে দেহের ক্যানসার সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধংস করে ও ক্যানসারের কোষ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই নিয়মিত সিরকা খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে ।
কোষ্ঠকাঠিন্য : যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা রয়েছে তারা প্রতিদিন খাবার পর ১ গ্লাস কুসুম গরম পানিতে ২ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ২ র্কক সিরকা মিশিয়ে দিনে ২ বার আথবা লাল চা এর সাথে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১র্কক সিরকা খেলে ইনশাআল্লাহ কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা সম্পূর্ণ রুপে দূর হবে ।
ডায়রিয়া ও অন্ধ্রের অন্যান্য রোগ : ডায়রিয়া হলে ১ চামচ মধুর সাখে ১ টেবিল চামচ অথবা বোতলের র্ককর দিয়ে ১ র্কক সিরকা মিশিয়ে দিনে কয়েক বার সেবন করলে ডায়রিয়াসহ অন্ধ্রের অন্যান্য রোগে কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায় ।
অনিদ্রা দূর করে : অনেকেই আছেন যাদের অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে । রাতে ঘুমাতে যাদের সমস্যা হয় তারা সিরকা ব্যবহারে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন । প্রতিদিন রাতে ঘুমের আগে কুসুম গরম পানির সঙ্গে সিরকা মিশিয়ে সেই পানিতে গোসল করে নিলে শরীরের স্নায়ুর উত্তেজনা কমে এবং মন শিথিল হবে ও প্রশান্তি আসবে। ফলে সহজেই ঘুম চলে আসবে ও ঘুম গভীর হবে এবং ঘামের দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া প্রতিহত করবে ও শরীরের দূর্গন্ধ দূর হবে ।
ক্লান্তি দূর করা : সিরকা খেলে শরীরের রক্ত প্রবাহ সচল থাকে এবং রক্তে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ে। এ ছাড়াও সিরকা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্লান্তি দূর করা এবং শরীরের বিভিন্ন স্বাভাবিক কার্যাবলীকে সচল রাখে। ফলে নিয়মিত সিরকা খেলে শরীর চনমনে থাকবে এবং ক্লান্তি ভাব কমে যাবে।
উজ্জ্বলতা রক্ষার্থে : শরীরের উজ্জ্বলতা রক্ষার্থে সিরকা বেশ কার্যকর। এর জন্য বাথটাবে হালকা গরম পানির সাথে প্রায় ৮ ছটাক পরিমান সিরকা মিশিয়ে এর মধ্যে ১৫ মিনিট শরীরটাকে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এর ফলে শরীরের ত্বকের বিভিন্ন স্থানের রঙের ভারসাম্য রক্ষার্থে সাহায্য করবে ।
ব্রণ ও রোদে পোড়া ভাব দূরকরতে : ব্রণ ও রোদে পোড়া ভাব দূরকরতে রাতে ঘুমানোর আগে মুখ মন্ডল ভাল করে ধূয়ে পরিষ্কার করে ১ চা চামচ মধুর সাথে ১ চা চামচ সিরকা মিশিয়ে ভাল ভাবে সমস্ত মুখে মেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে ধূয়ে ফেলতে হবে । এই ভাবে কয়েক দিন করলে ব্রণ ও রোদে পোড়া ভাব দূর হবে ও চেহারা উজ্জল হবে ।
চুলের যত্নে : চুলের যত্নে সিরকা বেশ উপকারী । সিরকা চুলের খুসকি দূর করে। এর জন্য ১ কাপ পানিতে ২ টেবিল চামচ সিরকা মিশিয়ে ভাল ভাবে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করে ১০ মিনিট রেখে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে । কয়েক দিন ব্যবহার করলে খুসকি দূর হবে। এছাড়াও চুলের কন্ডিশনার হিসাবে সিরকা চমৎকার প্রাকৃতিক কন্ডিশনারের হিসাবে কাজ করে, এজন্য শ্যাম্পু করার পর এক মগ পানিতে ২ টেবিল চামচ সিরকা মিশিয়ে চুল ধূয়ে নিলে চুল ঝলমলে আর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
পায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে : অনেকের পায়ে বাজে ধরনের দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। এটি ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাসের কারণে হয়ে থাকে। এই দুর্গন্ধ দূর করতেও সিরকা অত্যন্ত উপকারী। এজন্য ৪ কাপ পানিতে ১ কাপ সিরকা মিশিয়ে মিশ্রণটিতে ১৫ মিনিট পা ভিজিয়ে রাখতে হবে। ১৫ মিনিট পর পা ভালোভাবে পানিতে ধূয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে নিতে হবে । এভাবে কয়েক দিন করলে পায়ের দুর্গন্ধ, ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাসের দূর হবে ।
জীবানু মুক্ত করতে : কোনো কিছু জীবানু মুক্ত করতে পানির সাথে কয়েক চামচ সিরকা মিশিয়ে তাতে ৫-১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে তা জীবানু মুক্ত হবে।হাত পা বা শরীরের কো অংশে ছোট-খাছো কাঁটা ছিঁরায় পানির সাথে সিরকা মিশিয়ে ধূলে কাঁটা স্থান জীবানু মুক্ত হবে ।