মধুর উপকারিতা ও ব্যবহার
মধুতে বিদ্যমান রয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এর ফলে নিয়মিত খাঁটি মধু পানে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়।
মধু আমাদের শরীরে তৎক্ষনাৎ শক্তি যোগায়, শারীরিক দুর্বলতা দূর করে এবং শরীরে তাপ উৎপন্ন করে ।
মধু আমাদের শরীরে খাবারের হজমশক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সহায়তা করে ৷
যারা রক্তশূন্যতায় ভুগছেন, মধু তাদের জন্য অত্যন্ত উপকারি। রক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তার মাধ্যমে মধু শরীরের রক্তশূণ্যতা দূর করে।
মধু আমাদের শরীরে রক্তনালী প্রসারণের মাধ্যমে হৃদপেশির কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং শরীরে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে।
মধুতে রয়েছে বিভিন্ন খনিজ উপাদানসমূহ। নিয়মিত মধু পানে আমাদের শরীরে এসব খনিজের (কপার, লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি) অভাব পূরণ হয়৷
মুখের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ঘায়ের চিকিৎসায় মধু খুবই কার্যকরী এবং মধু আমাদের দাঁতকে মজবুত করে।
মৌসুমি সর্দি, জ্বর উপশমে তুলসি পাতার রসের সঙ্গে খাঁটি মধু মিশিয়ে কয়েকদিন নিয়মিত পান করলে এটা দারুণভাবে কাজ করে।
যারা ফুসফুসের বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন এমনকি যাদের ফুসফুস করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ তাদের জন্যও মধু খুবই কার্যকরী৷
মধু দিয়ে গাঁজানো রসুন নিয়মিত সেবনে ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন নিরাময়, শরীরের ওজন কমানো, রক্তের কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমানো, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি উপকারিতা পাওয়া যায়।
মধু শিশুদের হাড়ের গঠন মজবুত করে, দৃষ্টিশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
রাতের বেলা দুধের সঙ্গে মধু মিশিয়ে পান করলে অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে।
শারীরিক এবং যৌন দূর্বলতা দূরীকরণে মধুর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা ৷
মধু পানে শরীরের কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূর হয় ৷
নিয়মিত মধু পান বাতের ব্যথা উপশম করে।
মধুতে বিদ্যমান অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ত্বকের রং সুন্দর করে এবং তারুণ্যতা বজায় রাখতে সহায়তা করে ৷
মুখের ব্রণ এর চিকিৎসায়, ত্বক এবং চুলের রূপচর্চায় মধু ব্যবহারে বিশেষ সুফল পাওয়া যায় ।
মধু হল মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রাকৃতিক এ্যান্টিবায়োটিক । যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় ৷ মধুতে বিদ্যমান প্রাকৃতিক গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ আমাদের শরীরে তৎক্ষনাৎ এনার্জি যোগায় ৷ এছাড়া মধুতে রেয়েছে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, অ্যামাইনো এসিড, খনিজ লবণ ইত্যাদি ৷
আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে আদেশ দিলেনঃ পাহাড়ে, গাছে এবং উঁচু চালে গৃহ তৈরী কর, এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙে পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্যে রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আন-নাহল(১৬), আয়াতঃ ৬৮-৬৯)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মধুতে আরোগ্য নিহিত আছে।’ (সহীহ বুখারি: ৫২৪৮)
আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে মধু ও মিষ্টান্ন খুব প্রিয় ছিল। (সহীহ বুখারি: ৫২৫০)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি মাসে ৩ দিন সকালে মধু চেটে খাবে, তার বড় ধরনের কোনো রোগ হবে না।’(ইবনে মাজাহ : ৩৪৪১)
আয়্যাশ ইবন ওয়ালীদ (রহঃ) আবূ সা’ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। এক ব্যাক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললঃ আমার ভাইয়ের পেটে অসুখ হয়েছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাকে মধু পান করাও। এরপর লোকটি দ্বিতীয়বার আসলে তিনি বললেনঃ তাকে মধু পান করাও। সে তৃতীয়বার আসলে তিনি বললেনঃ তাকে মধু পান করাও। এরপর লোকটি পুনরায় এসে বললঃ আমি অনুরূপই করেছি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ সত্য বলেছেন, কিন্তু তোমার ভাইয়ের পেট অসত্য বলছে। তাকে মধু পান করাও। সে তাকে মধু পান করাল। এবার সে আরোগ্য লাভ করল । (সহীহ বুখারি অধ্যায়ঃ চিকিৎসা হাদিস নাম্বারঃ ৫২৮২)
বিজ্ঞানও মধুর অনেক উপকারিতার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।মধু খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা এর মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, হজমশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি-জ্বর উপশম, কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূরীকরণ, ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন নিরাময়, শরীরের ওজন কমানো, রক্তের কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমানো, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এবং মধু খাওয়ার সবচেয়ে উত্তম নিয়ম হলো প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১-২ চা-চামচ মধু পরিষ্কার হাতের তালুতে নিয়ে চেটে খাওয়া।
মধুতে বিদ্যমান উপাদানসমূহ
খাঁটি মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান বিদ্যমান । প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন ফুল থেকে মৌমাছিরা যে মধু সংগ্রহ করে এতে থাকে প্রায় ২৫ - ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ - ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ - ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫ - ১২ শতাংশ মল্টোজ ৷ এছাড়াও প্রায় ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড, প্রায় ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং প্রায় ১১ শতাংশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক এনজাইম ৷ খাঁটি মধু চর্বি ও প্রোটিনমুক্ত । ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে প্রায় ২৮৮ ক্যালরি ।
মধু খাওয়ার নিয়ম
দমধু খাওয়ার বিশেষ তেমন কোন নিয়ম নেই । তবে অবশ্যই নিয়মিত মধু পান সর্বোত্তম ৷ এতে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম অনেক শক্তিশালী হবে । পাশাপাশি যে উপকারিতাগুলি পাওয়া যায় সেগুলিও দৃশ্যমান হবে। এবং পূর্বের থেকে অবশ্যই ভাল অনুভব করবে । এই পর্যায়ে মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম গুলি তুলে ধরা হল ।
প্রতিদিন সকালে ১-২ চা চামচ মধু সরাসরি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারেন । এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী ।
মধু শরীরের ওজন কমাতে কাজে লাগে। রোজ সকালে কুসুম গরম পানির সাথে ১ – ২ চা চামচ মধুর সঙ্গে ১চা-চামচ সিরকা বা লেবুর রস মিশিয়ে খালি পেটে পান করবেন । এতে আপনার শরীরের মেদ কমবে ।
কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে রেখে এর সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে শারীরিক দুর্বলতা দ্রুত দূর হবে।
ব্রেড বা রুটির সাথে মধু খেতে পারেন ৷ এটি খেতে বেশ সুস্বাদু। পাশাপাশি অধিক এনার্জী পাবেন ৷
চায়ের সঙ্গে চিনি এর পরিবর্তে মধু পান করতে পারেন ৷ চিনিকে বলা হয়ে থাকে ‘হোয়াইট পয়জন’। এটি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ৷
দুধের সঙ্গে মধু মিশিয়ে পান করতে পারেন ৷ এটি খুবই উত্তম একটি পানীয় ৷ তবে অবশ্যই দুধ গরম থাকা অবস্থায় এতে মধু দিবেন না । তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে তখন মধু মিশিয়ে খাবেন ৷
আমরা জানি কালোজিরা হল সকল রোগের মহা ঔষধ। ৩-৭ ফোঁটা কালোজিরার তেলের সাথে ১ চা চামচ মধু নিয়মিত পান করুন। এতে অনেক জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাবেন ইনশাআল্লাহ।
মধু এবং লেবুর শরবত খুবই উত্তম পানীয়। মধুতে বিদ্যমান খাদ্য উপাদানগুলি শরীরে তৎক্ষণাৎ শক্তি যোগায়। শরীরের ক্লান্তি দূর করে।
যারা কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভুগছেন তারা ১ মগ পানিতে ২ চা চামচ ইসুফগুলের ভুসি এবং ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খালি পেটে কয়েকদিন পান করলে ভাল সুফল পাবেন।
রক্তনালীর বিভিন্ন সমস্যায় মধু বিশেষ উপকারী। মধুর সঙ্গে দারচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে নিয়মিত কিছুদিন খেলে রক্তনালীর সমস্যা দূর করবে। এমনকি রক্তে বিদ্যমান খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ প্রায় ১০ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে খাঁটি মধু।
সর্দি-জ্বর নিরাময়ের জন্য তুলসি পাতা বা বাসক পাতার রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে খুবই ভাল কার্যকারিতা পাওয়া যায় ।
রান্নায় সরাসরি মধু ব্যাবহার করা যাবে না। খাবারে মধু মিশিয়ে মিষ্টি করতে রান্না শেষ হবার পরে তাতে মধু মিশাতে হবে ।
ফুটন্ত পানি কিংবা দুধে সরাসরি মধু যোগ করা যাবে না। পানি বা দুধ পানযোগ্য তাপমাত্রায় আসলে তারপর এতে মধু যোগ করতে হবে ।
যেসকল বাচ্চাদের বয়স ১ বছর বা ১২ মাসের কম, তাদের কোন ক্রমেই মধু খেতে দেয়া যাবে না৷ কারণ ১ বছরের কম বয়সে বাচ্চাদের পরিপাকতন্ত্র পুরোপুরি সুগঠিত থাকে না ৷ বাচ্চার বয়স ১২ মাস হওয়ার পরে, দৈনিক অল্প পরিমাণে মধু খাওয়ানো অভ্যাস তৈরি করতে হবে ৷
মধু দিয়ে গাঁজানো রসুন এর মিশ্রণ তৈরি করে প্রতিদিন সকালে এক কোয়া রসুন এবং এক চা-চামচ মধু সেবন করলে ইরেকটাইল ডিসফাংশন বা প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন নিরাময়, রক্তের কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমানো, প্রভৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
মধু খাওয়ার উপযুক্ত সময়
সারাদিনের যেকোন সময়েই মধু পান করা যায় । দিনের যেকোনো সময়ে যখনই ক্লান্ত অনুভব হয় মধু খেলে তৎক্ষণাৎ প্রশান্তি পাওয়া যাবে এবং শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি যোগাবে।
তবে মধু খাওয়ার উপযুক্ত সময় হলো সকালে খালি পেটে মধু পান করা। এতে অধিক উপকারিতা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সকালে খালি পেটে কয়েক চামচ মধু হাতের তালুতে নিয়ে চেটে চেঠে খেতে পারেন। কিংবা মধু দিয়ে শরবত তৈরি করেও পান করা যায় । শরবতে সিরকা, লেবুর রস, চিয়া সিড এগুলিও ব্যবহার করা যায় ।
কোন মধু স্বাস্থের জন্য সবচেয়ে উপকারি
সব মৌসুমের খাঁটি মধুতেই রয়েছে প্রায় সমান গুণাগুণ৷ মৌসুম ভেদে মধুর স্বাদ, ঘ্রাণ এবং ঘনত্বের পরিবর্তন হয় ৷ কিন্তু বাজারে পাওয়া যায় এমন সব ধরণের মধুই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারে আসবে না । খোলা বাজারে যে সমস্ত মধু পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ভেজাল অথবা নকল । আর আমরা সবাই জানি, মধু আমাদের জন্য যেমন খুবই উপকারী তেমনি ভেজাল বা নকল মধু আমাদের শরীরের জন্য ততটাই ক্ষতিকর । তাই সবসময় চেষ্টা করবেন প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন ভাল মানের মধু পান করা, এতে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যায় ।